এফ এম শরিফুল ইসলাম শরীফ :
ইতিহাস ঐতিহ্যের ধারক বাহক পুরনো ঢাকার জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।বিশ্বের একমাত্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এটি যা পাঠশালা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হয়। ২০০৫ সালে তৎকালীন বিএনপি জামায়াত জোট সরকার জগন্নাথ কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর করে। তবে তখন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় আইনে একটি ধারা উল্লেখ করা হয়। সেটি ২৭/৪ ধারা নামক একটি ধারা জুড়ে দেওয়া হয়। এ ধারার ফলে পাঁচ বছর পর জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়কে নিজস্ব আয় দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়টি নিজেই পরিচালিত হবে।যেটা আসলে ছিল সু-কৌশলে একটি সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর করা। তবে সেই আইনের বিরুদ্ধে ২০০৯ সালে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের নেতৃত্বে কালো ধারা বাতিলের আন্দোলন শুরু হয়। ২৭/৪ নামক ধারার বিরুদ্ধে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের সকল সদস্য আন্দোলন করে। আন্দোলনে প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সভাপতি এইচ এম বদিউজ্জামান সোহাগ ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের আহ্বায়ক কমিটির নেতৃবৃন্দের মাধ্যমে শিক্ষা বন্ধক নেত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় সংসদে সেই ২৭/৪ কালো ধারা বাতিল করে বিশ্ববিদ্যালয়কে একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিপূর্ণ রুপ দেন। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় একটি অনাবসিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে যাত্রা শুরু করে।যদিও ইতিহাস বলে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক ছাত্রাবাস ছিল যেগুলো দেশভাগের সময় বেদখল হয়ে যায়।আবাসিক সংকট নিরাসনের জন্য বিভিন্ন সময় বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করে। ঠিক সেরকম একটি আন্দোলন হয় ২০১০ সালে হল নির্মাণের জন্য আন্দোলন। সেই আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিল জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ঠিক পূর্ব-দক্ষিণ কোনায় আজকের যে এক হাজার শিক্ষার্থীর আবাসন বিশিষ্ট সুউচ্চ ছাত্রী হল দাঁড়িয়ে আছে, এই ছাত্রী হলের জায়গায় বাংলাবাজার স্কুলকে বরাদ্দা দেয় সরকার। স্কুল কর্তৃপক্ষ সাইনবোর্ড টাঙ্গিয়ে যায়।জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় তৎকালীন ছাত্রলীগের আহবায়ক সাইফুল ইসলাম আকন্দের নেতৃত্বে সেই সাইনবোর্ড ভেঙ্গে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ ছাত্রীদের জন্য নির্ধারিত স্থান হিসেবে হাতে লেখা প্রথম সাইনবোর্ড টানায়।পরবর্তীতে কালক্ষেপণ হচ্ছিল, ঠিক ২০১৪ সালে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা হল আন্দোলনের জন্য আন্দোলন শুরু করে যে আন্দোলনের নেতৃত্বেও ছিল ছাত্রলীগ,। আমি ছাত্রলীগের সভাপতি,সাধারণ সম্পাদক এস এম সিরাজুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তখন আন্দোলনে দিশেহারা। উপাচার্য ছিলেন অধ্যাপক ডক্টর মিজানুর রহমান স্যার। স্যার আমাকে ডেকে বললেন তোমরা যে ছাত্রী হলের ব্যানার টাঙ্গিয়েছো, ওখানে আওয়ামী লীগের অফিস আছে, রিক্সা গ্যারেজ আছে,বড় বড় দুটো গাছ আছে, এগুলো সব অপসারণ করতে হবে। এই দায়িত্ব তোমাদের নিতে হবে। তখন উপাচার্য মহোদয় কে আমরা বললাম সব অপসারণ করতে পারবো,স্যার যদি আপনি ওখানে দাঁড়িয়ে থাকেন। যেই কথা সেই কাজ, স্যার দাঁড়িয়ে রইলেন আমি আর সিরাজ ছাত্রলীগের নেতৃবৃন্দদের নিয়ে এবং সাধারণ শিক্ষার্থীদের সাথে নিয়ে আওয়ামী লীগের অফিস রিক্সা গ্যারেজ এবং সকল স্থাপনা অপসারণ করি এবং বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব ছাত্রী হল নামে পুনরায় সাইনবোর্ড টাঙ্গিয়ে দেওয়া হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডক্টর মিজানুর রহমান স্যার শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় নির্মাণ করলেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ইতিহাসের প্রথম ছাত্রী হল বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হল। যে হলের কোন কাগজপত্র বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে নেই। ২০১৪ সালে আগস্টের শুরুর দিকে ছাত্রলীগের নেতৃত্বে হল উদ্ধার এবং নতুন হার নির্মাণের জন্য আন্দোলনে আমরা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের সকল সদস্য এক এবং অভিন্ন। নতুন নতুন কর্মসূচি দিই বেদখলকৃত হলগুলো উদ্ধার করার এবং নতুন হল নির্মাণের জন্য। ইতিমধ্যে আমরা আব্দুর রহমান হল, সৈয়দ নজরুল ইসলাম হল, বাণীভবন উদ্বার করে নিজেদের দখলে নিতে সক্ষম হই।নজরুল ইসলাম হল উদ্ধার করার জন্য স্থানীয়দের তোপের মুখে পড়ি, সেখানে সরকার একজন মুক্তিযোদ্ধা কে ওই জায়গা বরাদ্দ দিয়েছিল, সেই বরাদ্দকৃত জায়গা জেলা প্রশাসকের হস্তক্ষেপে আমরা লিজ নিতে সক্ষম হই ।বহুল আলোচিত তিব্বত হল অভিমুখে কর্মসূচি দেই,তিব্বত হল এর জায়গায় সেখানে গুলশানারা সিটি। গুলশানারা সিটির দোকান মালিক,অ্যাপার্টমেন্ট মালিক এবং পজিশন মালিকদের প্রতিরোধের মুখে পড়ি।আমাদের শ্রদ্ধাভাজন নাসির স্যার সহকারে অনেক শিক্ষক শিক্ষার্থী সেদিন পুলিশের গুলিতে আহত হই। ৪ জানুয়ারি ২০১৪, ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে আমরা গণভবনে যায়।মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার প্রোটোকল অফিসার খুরশিদ আলম ভাই প্রধানমন্ত্রীর সাথে আমাকে এবং সাধারণ সম্পাদক এস এম সিরাজুল ইসলামকে দেখা করিয়ে দেন।আমরা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে বোঝাতে সক্ষম হই জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়কে আধুনিক পরিবেশে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। প্রায় এক ঘণ্টার মতো মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সাথে আমরা দুজন কথা বলি,মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেন এটা একটা বিশ্ববিদ্যালয় হল যেখানে কোন হল নেই যেখানে কোন খেলার মাঠ নাই জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কে আমি একটি আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়ের রূপান্তরিত করব।তিনি বললেন আমি নসরুল হামিদ বিপুকে বলতেছি কেরানীগঞ্জে ৫০০ একর জায়গা খুঁজে বের করার জন্য। যে কথা সেই কাজ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় অদূরে মনোরম পরিবেশে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে জায়গা খুঁজে পাওয়া গেল জমি। জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে জমি একোয়ার করে বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে হস্তান্তর করল ।আজ সেখানে বিভিন্ন স্থাপনা হচ্ছে যেটি আসলেই প্রকৃত অর্থে ছাত্রলীগের অর্জন।জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে ছাত্র শিক্ষকদের জন্য টিএসসি নামক যে জায়গাটি রয়েছে এই জায়গাটি সমবায় ব্যাংকের,যেহেতু পরিত্যক্ত জায়গা হিসেবে এখানে রয়েছে। আন্দোলনের সময় কর্মসূচি দিলাম এই জায়গা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়কে দিতে হবে, যে কথা সেই কাজ। শিক্ষার্থীরা মুহূর্তের ভিতর সকল স্থাপনা ভেঙ্গে গুড়িয়ে দিয়ে ছাত্র শিক্ষকদের জন্য নির্ধারিত জায়গায় হিসেবে সাইনবোর্ড টাঙিয়ে দেই।যা বর্তমানে টিএসসি নামে পরিচিত। যে অর্জনটা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের । আমরা জানি ভাষা আন্দোলন করতে গিয়া জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের শিক্ষার্থী শহীদ রফিক আত্মহতি দেয়। তাকে স্মরণ করে বিশ্ববিদ্যালয় কোন স্থাপনা ছিল না।আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের মাঝ থেকে কর্মসূচি দিলাম এই বিজনেস স্টাডি ভবনের নাম পরিবর্তন করে ভাষা শহীদ রফিকের নামে ভবনের নামকরণ করতে হবে। ঠিক কয়েকদিনের ভিতর জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় প্রধান প্রকৌশলী সুকুমার চন্দ্রের তত্ত্বাবধয়নে নামকরণ পরিবর্তন করে ভাষা শহীদ রফিক ভবন নামকরণ করা হয়। বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে এই জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সেরকম কোনো উৎসব হতো না বড় বড় কনসার্ট করতে অনেকে ভয় করত। আমরা উদ্যোগ নিলাম প্রত্যেকটি প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে আমরা পুরনো ঢাকার একটি উৎসব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করলাম,জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে বাউল জেমস,আইয়ুব বাচ্চু সহ বাংলাদেশের বিখ্যাত খ্যাতিমান ব্যান্ড এবং শিল্পীদের দিয়ে মনোরম পরিবেশে বিশ্ববিদ্যালয় দিবসে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করতাম।যা ছিল আমাদের আনন্দের এবং উৎসবের মাত্রা। ছাত্রলীগের দাবির মধ্যে অন্যতম একটি দাবি ছিল এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক হিসাবে নিয়োগ দিতে হবে। আমাদের কথায় গুরুত্বসহকারে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক এবং কর্মকর্তা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদের থেকে নিয়োগ দান শুরু হয় ।২০ শে অক্টোবর জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা বার্ষিকী,নিজের জীবনের সঙ্গে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের নামটি যেমন জড়িত,বিশ্ববিদ্যালয় দিবস আসলে সেই যৌবনের উচ্ছ্বাস উদ্দীপনা কর্ম পন্থা সবই হৃদয় মাঝে এবং চোখে ভেসে ওঠে।আজকের এই দিনে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল শিক্ষক শিক্ষার্থী কর্মকর্তা কর্মচারী সবাইকে বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাই।
লেখক: এফ এম শরিফুল ইসলাম শরীফ।
সাবেক শিক্ষার্থী বাংলা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।
সাবেক প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় আবৃত্তি সংসদ ও সাবেক সভাপতি, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ।