ফরহাদ খান,বিডি বাংলা নিউজ ২৪
ভালোবাসার নামে সহিংসতা, অ্যাকশনের নামেও বেহাল চিত্রনাট্য—দর্শক যেন রঙিন এক খাঁচায় আটকে থাকা পাখি, যার গানে সুর আছে, কিন্তু প্রাণ নেই।
শুরুটা যেন কাব্যেই বলা যায়:
রঙে রঙে ছাওয়া ফ্রেম, তবু গল্পে নেই রোদের দ্যুতি,
শাকিব খান ‘দানব’ হয়ে এলেন, গল্প রইল শুধুই ক্ষণিকের সুখস্মৃতি।
‘তুফান’-এর সাফল্যের পরে ‘বরবাদ’ ছিল ঢালিউডপ্রেমীদের জন্য এক বড় প্রত্যাশা। বড় বাজেট, ঝাঁ-চকচকে লোকেশন, সিনেমাটোগ্রাফি, ফ্যাশনেবল লুক, আরেকটু বাড়িয়ে বললে বলা যায়—এই সিনেমা দেখতে গিয়ে মাঝেমধ্যে মনে হচ্ছিল, এটা কোনো আন্তর্জাতিক অ্যাকশন ফিল্ম না তো? এত নিখুঁত ভিজুয়াল আর প্রোডাকশন ডিজাইন দেখে বিশ্বাস করা কঠিন, এটা বাংলাদেশের নির্মাণ!
কিন্তু এই দৃশ্যরূপের নিচে লুকিয়ে আছে একটি ফাঁপা গল্প—যেটা ‘বরবাদ’ করেছে সময়, আবেগ, আর ঈদের দিনটি।
বড় আয়োজন, ছোট গল্প
শাকিব খানের চরিত্র আরিয়ান মির্জা—একটি প্রতাপশালী ‘বিষাক্ত নায়ক’—যার প্রেমে একরকম জোর-জবরদস্তি, প্রতিশোধের নামে হিংস্রতা আর কনফিউশনের এক ঝলমলে প্যাকেজ। তবে এমন চরিত্রে শাকিবের অভিনয় দারুণ হলেও, দর্শকের সহানুভূতি ধরে রাখার মতো গল্প নেই এখানে।
সিনেমার প্রথমার্ধ যতটা চমকপ্রদ আর ‘সিনেম্যাটিক’, দ্বিতীয়ার্ধ ততটাই তাড়াহুড়ো করে সাজানো। হুট করে টুইস্ট, হুট করেই ফ্ল্যাশব্যাক—দেখতে দেখতে মনে হয়, যেন গল্প বলার চেয়ে একটার পর একটা চোখধাঁধানো দৃশ্য দেখানোই ছিল মূল উদ্দেশ্য।
কলকাতার উচ্চারণ, ঢাকার ছবি?
সবচেয়ে যেটা দৃষ্টিকটু লেগেছে—সেটা হলো, সিনেমায় অভিনেতাদের সংলাপ উচ্চারণ। শাকিব খানের বিপরীতে থাকা ইধিকা পাল ও তাঁর বোনের চরিত্রে থাকা রিয়া গাঙ্গুলি চক্রবর্তীর কথায় কলকাতার টান এতটাই প্রকট, যে সময় সময় বোঝাই যায় না, এটা ঢাকাই সিনেমা নাকি টলিউডের কোনো ডাব করা প্রজেক্ট!
অন্যদিকে, স্যাম ভট্টাচার্যের ‘জিল্লু, মাল দে’ সংলাপ ভাইরাল হলেও, তাঁর বাংলা বলার ভঙ্গিতে দেশি ভাবটা হারিয়ে গেছে অনেকখানি। দর্শক যদি একটা বাংলাদেশি সিনেমায় বারবার ভাষাগত ব্যাঘাত অনুভব করেন, তাহলে গল্পে প্রবেশ করাটাও কঠিন হয়ে পড়ে।
পারফরম্যান্স: শাকিব দুর্দান্ত, যীশুর অপচয়
আরিয়ান চরিত্রে শাকিব খানের দুই লুকই দারুণ। প্রথমদিকে রাগী, বখে যাওয়া ছেলে, পরে এক পাগল প্রেমিক ও প্রতিশোধপরায়ণ যুবক—উভয় রূপেই চমকে দিয়েছেন। তবে তাঁর সবচেয়ে বড় প্রতিপক্ষ হিসেবে যীশু সেনগুপ্তকে আনা হলেও, শাকিব-যীশুর মধ্যে কাঙ্ক্ষিত দ্বৈরথ গড়ে ওঠেনি। এত শক্তিশালী অভিনেতাকে এমন কমজোরি চিত্রনাট্যে নষ্ট করাটা সত্যি আফসোসের।
গান ও গ্ল্যামার: চোখের আরাম, কানে ‘বিপ’
গানগুলো, বিশেষ করে ‘মায়াবী’ ও ‘মহামায়া’, সত্যিই ভালো লেগেছে। কিন্তু সিনেমায় কিছু সংলাপ এবং সহিংসতার দৃশ্য সেন্সর করতে গিয়ে ‘বিপ বিপ’ শুনতে শুনতে বিরক্ত হয়ে উঠবেন দর্শক।
একখণ্ড অনুভব
‘বরবাদ’ এমন এক সিনেমা, যা চোখকে প্রশান্তি দেয়, কিন্তু হৃদয়কে ছুঁয়ে যায় না। সিনেমা শেষে আপনি হয়তো বলবেন—দারুণ লোকেশন, সুন্দর গান, চোখ ধাঁধানো অ্যাকশন… কিন্তু তারপর? কিছু কি সঙ্গে নিয়ে ফিরলেন?
না, বরং ফিরলেন একরাশ অপূর্ণতার গ্লানি নিয়ে—ভালো কিছু হতো, যদি গল্পটাও সমান দৃষ্টিনন্দন হতো।
‘বরবাদ’ কেবল নামেই নয়, এটি সময়েরও এক বরবাদ—যেখানে ঢাকাই সিনেমার সম্ভাবনাময় এক অধ্যায় চোখের সামনে এসেও গল্পে হেরে গেল। শাকিব খান, পরিচালক মেহেদী হাসান, পুরো টিম আরও ভালো কিছু উপহার দিতে পারতেন—শুধু যদি ‘ভিজুয়াল’ না হয়ে গল্পের দিকেও সমান গুরুত্ব দিতেন।