গাজা : ইতিহাস একদিন বিশ্ববিবেকের এই নীরবতাকেও বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাবে

তাজবীর সজীব


গাজা—একটি ছোট ভূখণ্ড, অথচ বিশ্বের সবচেয়ে আলোচিত ও রক্তাক্ত ভূমি। এখানে শিশুর কান্না থামে না, মায়ের বুক খালি হতে হতে পাথর হয়ে যায়, আর ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে যায় হাজারো স্বপ্ন। এই আগ্রাসী অভিযান এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে এই রক্তাক্ত ইতিহাসে। আজ, যখন গাজার আকাশে আবারো আগুনের ফুলকি, ভূমিতে আবারো লাশের সারি, তখন এই প্রশ্ন জোরালোভাবে ওঠে—বিশ্ব কি কেবল দর্শক হয়ে থাকবে?

এই যে নির্বিকার দৃষ্টিতে পৃথিবী গাজার দিকে তাকিয়ে আছে, এই যে বড় বড় রাষ্ট্র মানবাধিকারের বুলি আওড়িয়েও নিরবতা পালন করছে, সেটি নিছক কূটনৈতিক সমতা নয়—এ একধরনের সহযোগিতামূলক অপরাধ। এটি ইতিহাসের সেই অন্ধকার অধ্যায়, যেখানে ন্যায়বিচার অনুপস্থিত, আর নীরবতা হয়ে উঠেছে সবচেয়ে বড় সহিংসতা।

একটি বন্দী শহরের গল্প

গাজা একটি খোলা কারাগার। চারপাশে সীমান্ত প্রাচীর, আকাশপথে নিয়ন্ত্রণ, সমুদ্রপথেও অবরোধ। ফিলিস্তিনের এই উপত্যকায় প্রায় ২০ লক্ষ মানুষ গাদাগাদি করে বেঁচে থাকে। জল, বিদ্যুৎ, চিকিৎসা—সবকিছুতে সংকট। বছরের পর বছর ধরে চলা এই অবরোধ, এই অবজ্ঞা আর অস্ত্রের ঝনঝনানি এক অবর্ণনীয় মানবিক বিপর্যয়ে রূপ নিয়েছে।

এই যুদ্ধ পরিস্থিতি আগের সব রেকর্ড ছাপিয়ে গেছে। হাসপাতাল লক্ষ্যবস্তু, সংবাদমাধ্যম লক্ষ্যবস্তু, এমনকি জাতিসংঘ পরিচালিত স্কুলেও হামলা হয়েছে। শিশুরা যখন ঘুমাচ্ছে, তখন বোমার শব্দে তারা জেগে উঠে মৃত্যু দেখতে দেখতে বড় হচ্ছে—যদি বেঁচে থাকে।

বিশ্ব বিবেক কোথায়?

জাতিসংঘ থেকে শুরু করে মানবাধিকার সংস্থাগুলো বারবার “চরম উদ্বেগ” প্রকাশ করছে। কিছু দেশের নেতারা ‘উদ্বেগ’ প্রকাশ করে বক্তব্য দিচ্ছেন, কিছু রাষ্ট্র মাথা নিচু করে নিজেদের অস্ত্র চুক্তি রক্ষা করতে ব্যস্ত। কিন্তু প্রশ্ন হলো—উদ্বেগ দিয়ে কি মৃত্যু থামে? ‘ভীষণ উদ্বেগ’ জানিয়ে কি ধ্বংসের লাগাম টানা যায়?

একটি শিশু যখন তার মায়ের নিথর দেহকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে, তখন সেই কান্না মানবতার কানে পৌঁছায় না কেন? প্যালেস্টাইনের শিশুর জীবন কি কম মূল্যবান? এ কোন দ্বিমুখী মানবতা যেখানে ইউরোপে একটি বোমা পড়লে বিশ্ব কেঁপে ওঠে, কিন্তু গাজায় বোমার বৃষ্টি হলে সবাই চুপ থাকে?

মিডিয়া ও প্রপাগান্ডা

মূলধারার অনেক আন্তর্জাতিক মিডিয়া বরাবরের মতো পক্ষপাতদুষ্ট ভূমিকা পালন করছে। আক্রমণকারীকে আত্মরক্ষাকারী হিসেবে তুলে ধরা হয়, আর নিহত শিশুকে ‘কল্যাটারাল ড্যামেজ’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। এই প্রপাগান্ডা যুদ্ধ আরও বিপজ্জনক। যখন সত্যের ওপর পর্দা পড়ে যায়, তখনই মানবতা সবচেয়ে বেশি আহত হয়।

বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল বিশ্বের অবস্থান

বাংলাদেশ সবসময় ফিলিস্তিনের পক্ষে নৈতিক অবস্থান গ্রহণ করেছে। আমাদের জাতীয় নীতিমালার মধ্যেই পরাধীন জাতির মুক্তির পক্ষে সমর্থন স্পষ্ট। তবে শুধু বিবৃতি নয়, আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক মহলে জোরালো ভূমিকা রাখা দরকার। মুসলিম বিশ্বের বহু দেশ এখনো দ্বিধায় পড়ে আছে—ব্যবসায়িক স্বার্থ, সামরিক জোট, আর রাজনৈতিক বন্ধুত্বের কারণে তারা মুখ খুলতে পারছে না। কিন্তু ইতিহাস একদিন এই নীরবতাকেও বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাবে।

একবিংশ শতাব্দীতে গণহত্যা?

গাজার বর্তমান পরিস্থিতি নিঃসন্দেহে একটি গণহত্যা। আন্তর্জাতিক আইনে, ইচ্ছাকৃতভাবে নিরস্ত্র সাধারণ জনগণের উপর ব্যাপক হারে সহিংসতা চালানো—গণহত্যার পরিভাষার অন্তর্ভুক্ত। শিশু, নারী, প্রবীণ কেউই রক্ষা পাচ্ছে না। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত কিংবা জাতিসংঘ কি সত্যিই কোনো ভূমিকা রাখছে? নাকি এটি কেবল বড় রাষ্ট্রগুলোর রাজনৈতিক খেলায় পরিণত হয়েছে?

মানবতা কি ধর্ম দেখে?

ফিলিস্তিনের মানুষ মুসলমান বলেই কি তাদের পক্ষে দাঁড়ানো কঠিন? একজন শিশুর মৃত্যুতে তার ধর্ম খোঁজা কি সভ্যতার পরিচয়? মানবতা কোনো ধর্ম, বর্ণ, জাতি দেখে না। এটি হৃদয়ের ভাষা বোঝে। তাই যারা মানবতার কথা বলে মুখে, আর চোখের সামনে ঘটে যাওয়া এই ভয়াবহতাকে উপেক্ষা করে, তারা আসলে মানবতার চরম অবমাননাই করছে।

একটুকরো মানবিক পৃথিবীর খোঁজে

আমরা চাই না প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে নতুন করে গণহত্যার খবর শুনতে। আমরা চাই, একজন শিশুর কান্না যেন দুনিয়ার বিবেককে নাড়িয়ে দেয়। আমরা চাই, গাজায় শান্তির বাতাস বইুক, ধ্বংস নয়—গড়ে তোলার গল্প শুনি।

গাজা এখন একটুখানি ভালোবাসার অপেক্ষায়, কিছু সহমর্মিতার আকাঙ্ক্ষায়। আর এই মুহূর্তে চুপ করে থাকা মানে কেবল অপরাধের নীরব সাক্ষী হওয়া নয়—বরং ইতিহাসের এক অন্ধকার পাতায় নিজের নাম লিখে দেওয়া।

যখন গাজা রক্তাক্ত, তখন পৃথিবীর নীরবতা আর নিরপেক্ষতা—একটি সুপরিকল্পিত সহিংসতারই অংশ।

এই লেখাটি কোনো ধর্মীয় বা রাজনৈতিক পক্ষাবলম্বন নয়। এটি শুধুমাত্র একজন মানুষের, একটুখানি মানবিকতা নিয়ে বেঁচে থাকা হৃদয়ের আহ্বান—যারা বিশ্বাস করে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে নীরব থাকা মানেই অন্যায়ের পক্ষে দাঁড়িয়ে যাওয়া।


লেখক

সহকারী অধ্যাপক, সোনারগাঁও ইউনিভার্সিটি
সম্পাদক, দৈনিক অধিকার
উপদেষ্টা সম্পাদক, বিডি২৪লাইভ ডট কম

Tags :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

সর্বশেষ

BDBanglaNews is the country’s most authentic news portal.

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক

গোলাম জাকারিয়া

নির্বাহী সম্পাদক

ফরহাদ খান 

লিগাল এডভাইজার

এডভোকেট সুরাইয়া শান্তা

বার্তা সম্পাদক

এলিভ অবন্ত 

যোগাযোগ

© 2025 BDBanglaNews24.net All Right Reserved.